
এমন একটি সকালের কথা চিন্তা করা যাক, যেখানে ঘুম ভাঙানো, খবরের কাগজ এনে দেয়া, চা বানিয়ে বিছানায় নিয়ে আসা থেকে শুরু করে ঘরের খুঁটিনাটি সব কাজ করে দিচ্ছে একজন যে কিনা মানুষ না। কিছুটা খটকা লাগলেও এমনটা বেশিদিন দূরে নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) কল্যাণে মানুষ সামনে এমন এক বিশ্ব দেখতে যাচ্ছে যেখানে এআই হবে মানুষের সহযোগী।
ইউটিউবে ভয়েস কমান্ড দিলে চালু হচ্ছে পছন্দের গান, অ্যালেক্সার মতো ডিভাইস কথামতো সেবা দিচ্ছে, লাইট-ফ্যান বন্ধ হচ্ছে মুখের কথায়, মুখে যা বলা হচ্ছে হুবহু তা লেখা আকারে ওয়ার্ড ফাইলে উঠে যাচ্ছে, আরেকটি অ্যাপ আবার লেখার ভুল ধরে দিচ্ছে, নিজের মনমতো যেকোনো ভাষায় করা যাচ্ছে আপনা-আপনি অনুবাদ, রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশন করছে রোবট- এগুলো সবই এআই’র প্রাথমিক পর্যায়ের দেয়া সেবা। মানুষ তার নিজের সেবার জন্য আর মানুষকে ব্যবহার না করে এমন এক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাচ্ছে যা হুবহু মানুষের মতোই কাজ করবে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীটির নাম হচ্ছে মানুষ। সেই বুদ্ধিমান প্রাণীটিই বুদ্ধি খাটিয়ে এমন এক প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে যা মানুষের কথামতো কাজ করবে, দেবে নানা রকমের সেবা। এতে করে বদলে যাবে বৈশ্বিক হালচাল, পরিবর্তন আসবে জীবনধারণে। গ্রাহক সেবা থেকে স্বাস্থ্যসেবা, চাকরির সিভি বাছাই থেকে কর্মী নিয়োগ, এমন সব কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা যা আগে কল্পনা পর্যন্ত করা হয়নি- সম্ভব হবে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
একজন মানুষের পক্ষে ২৪ ঘণ্টা কাজ করা সম্ভব না। একটানা কোনো কাজ ১ ঘণ্টার বেশি করলে সেখানে কিছুটা স্থবিরতা চলে আসে- যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এআই ব্যবহার করে সেখানে একেকটি এআই দিয়ে একই কাজ, একই ধাচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা করানো যাবে। অনেকটা শিল্প বিপ্লবের সময়ে মেশিন যেভাবে মানুষের বিকল্প হয়েছিল; ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বিশ্বে মানুষের আরেকটি বিকল্প তৈরি হচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সহজ করে বললে, মানুষ দিয়ে যেসব কাজ করা হয়, সেগুলো বুদ্ধিমান রোবট দিয়ে করানো হলে বেচে যাবে খরচ ও সময়। ম্যাকেঞ্জি গ্লোবালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৭৫ মিলিয়ন মানুষের অর্থাৎ ১৪ শতাংশ মানুষের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে এই এআই।
ইন্টারেন্ট রেটিইলিংয়ের এক জরিপে দেখা যায়, করোনার সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে ৮৫ হাজার নতুন ই-কমার্স ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসা শুরু করলেই তো হবে না। এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যা অন্যদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকতে পারে। গ্রাহকের পছন্দ-অপছন্দ, জিজ্ঞাসা-উত্তরের তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারে। এজন্য ই-কমার্স ব্যবসাকে ঘিরে জমে উঠেছে এআই’র ব্যবহারও।
ই-কমার্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপশনটি হচ্ছে চ্যাটবুট। ক্রেতা পণ্য কিনতে গেলে তার কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা থাকে। চ্যাটে সেটি যখন-তখন জিজ্ঞাসা করতে পারেন তিনি। কিন্তু ক্রেতাকে তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে না পারলে তিনি হয়তো অন্য সাইট দেখবেন কিংবা মন বদলে ফেলতে পারেন। যেভাবে দোকানি আকর্ষণীয় কথা দিয়ে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে, সেভাবে এআই ২৪ ঘণ্টা ক্রেতাকে পণ্য সম্পর্কে আকর্ষণীয় বর্ণনা দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে। এছাড়া ক্রেতার এমন কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে যা এআই দিয়ে সামাধান করা সম্ভব নয়, সেখানেই এআই নিজেই ক্রেতাকে হিউম্যান সাপোর্টের ব্যবস্থা করে দেয়। এতে করে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক সুবিধা পেয়ে থাকে- যা প্রতিষ্ঠানের ওপর তার আস্থা বাড়ায়।
মাঝেমধ্যে ক্রেতারা পণ্য কেনার জন্য সিলেক্ট করেও ব্যক্তিগত কারণে পণ্য কিনে থাকেন না। এক্ষেত্রে এআই পরে তাদেরকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি পণ্যটি পছন্দ করেছেন কিন্তু এখনও কেনেননি। এছাড়া ডিসকাউন্ট দেয়া ও টার্গেট মার্কেটিংয়ের কাজটিও এআই করে থাকে। ক্রেতা কোন ধরনের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট এটা তার ব্রাউজিং দেখেই বোঝা যায়। সেই ডাটা ব্যবহার করে একই ধরনের পণ্য দেখাতে থাকলে এবং তার ওপর ডিসকাউন্টের মতো লোভনীয় অফার দিতে থাকলে, একটা সময় ক্রেতা পণ্য কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজন এআই ব্যবহার করেই অন্যসব প্রতিষ্ঠান থেকে এতদূর এগিয়ে আছে।
এআই তে যখন এগিয়ে যাচ্ছে সারাবিশ্ব তখন প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়। গুগলে বাঙালি এআই লিখে সার্চ করলে শুরুতেই যে ফলাফল আসে তা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। ২০১৭ সালে বুয়েট, কুয়েট ও ব্রাকের কিছু ছাত্রের হাত ধরে শুরু হয় ‘বাঙালি এআই’-এর যাত্রা। মূলত বাংলা ভাষাভিত্তিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া বিশ্বে কোডিং ও রোবোটিং প্রতিযোগিতায় যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে এআইতে বাংলাদেশ অগ্রগামীদের দেশ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনলাইন ডেস্ক 















