
নজরুল জুয়েল।। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে মানবিকতার পরিচয় দিয়ে উপজেলায় মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন যশোরের শার্শার মিজানুর রহমান মিজান।
জানা গেছে, ৫৩ বছর বয়সী মিজান পেশায় একজন মোটরসাইকেল মেকানিক। উপজেলার শার্শা বাজারে ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ নামে তার একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ রয়েছে। তিনি উপজেলার আমতলা গাতিপাড়ার অজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মিজান বর্তমানে উপজেলার শ্যামলাগাছি গ্রামে একটি ভাড়াবাড়ীতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় লেখাপড়াও করতে পারেননি মিজান। সংসারে অভাব অনটনের কারণে ছোট বেলা (৮-৯ বছর) বয়স থেকেই নেমে পড়েন মজুরের কাজে। তারপর মাঠে শ্যালো মেশিন চালানো এবং মেরামতের কাজ করতেন। পরে উপজেলার নাভারন বাজারে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজে কাজ পান তিনি। সেই থেকে মোটর মেকানিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয় তার।
মানবসেবা করতে গিয়ে সবকিছু দান করেছেন মানবদরদী মিজান। তারপরও থেমে নেই তার মানবিক কর্মকাণ্ড…
মিজানের মডেল মাদ্রাসা ও এতিমখানা :
অবহেলিত ও এতিম শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াতে শার্শার শ্যামলাগাছিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন হযরত শাহজালাল (রহ:) লতিফিয়া মডেল মাদ্রাসা ও এতিমখানা। বর্তমানে মাদ্রাসায় ছাত্রের সংখ্যা ৪১ জন। এখানে ১ম থেকে ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত ফ্রি পাঠদানের ব্যবস্থা আছে। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এ মাদ্রাসা থেকে দুইজন ছাত্র হেফজ সম্পন্ন করেছে। এবং ১৯ জন ছাত্র কোরআন শরিফ নাজেরা পড়ছে। পাশাপাশি ছাত্ররা নামাজ শিক্ষা, আযান, ইকামত, কিরাত ও গজল শিখছে। প্রতিদিন মাগরিব ও এশার নামাজের পরে সূরা ওয়াকিয়া ও সূরা মুলক তেলাওয়াত করা হয়। এবং সাপ্তাহিক সভার মাধ্যমে ইসলামিক বক্তব্যর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া হাতে কলমে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দক্ষ শিক্ষক দ্বারা আরবী,বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ ইত্যাদি বিষয়ে পাঠদান করানো হয়।
ফ্রি খাবার বাড়ি :
অনাহারে দিন পার করা ছিন্নমূল পথ শিশু, পথচারী, ভারসাম্যহীন মানুষদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্ষুধা লাগলে খেয়ে যান ‘ফ্রি খাবার বাড়ি’। যেখানে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি মিজান আত্মতৃপ্তি পেতে অভূক্ত প্রাণী কূলেও খাবার পৌঁছে দেন নিজের তৈরি মোটর গাড়িতে করে। ২০১৮ সাল থেকে ফ্রি খাবার বাড়ি কার্যক্রম শুরু করেন তিনি।
বেওয়ারিশ পুনর্বাসন কেন্দ্র ও কবরস্থান :
ইতিমধ্যে মিজান আরেকটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যশোরের ঝিকরগাছার উত্তর দেউলি গ্রামে ১০ শতক জায়গার উপর কবরস্থান ও বেওয়ারিশ পুনর্বাসন কেন্দ্রের ঘর নির্মাণ কাজের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন করেছেন। বেওয়ারিশ পুর্ণবাসন কেন্দ্রের এই জায়গাটি দান করেছেন ঝিকরগাছার ৭ নং নাভারণ ইউনিয়নের উত্তর দেউলি গ্রামের হোসনেয়ারা খাতুন।
এই পূর্ণবাসন কেন্দ্রটি তাদের জন্য করা হয়েছে। যাঁরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, যাদের নেই কোন ঠিকানা, যাদের কোন ওয়ারিশ পাওয়া যায় না এবং রাস্তাঘাটে চলতে চলতে মৃত্যুবরণ করেন। যাদের দাফন করার জন্য কেউ দায়িত্ব নিতে চাই না। তাদেরসহ অন্যান্য এলাকার মৃত মানুষের মরদেহ দাফন করতে একটি টিম বিনা খরচে কাজ করবে। ঠিক এসকল মানুষদের জন্য তার এই উদ্যোগ।
তার এই বেওয়ারিশ পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৫০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে বেওয়ারিশ মানুষদের ভরণপোষণ দেবেন তিনি। পাশেই রয়েছে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করার জন্য কবরস্থান। এ পুর্ণবাসন কেন্দ্রে রয়েছে দুটি বাথরুম, একটি রান্নাঘর, একটি আর্সেনিকমুক্ত কল ও একটি অফিস কক্ষ। এছাড়া ছোট বাচ্চাদের পাঠদান ও কোরআন শিক্ষার জন্য রয়েছে আলাদা ঘর। তার এই প্রকল্পের এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৯ লাখ টাকা। এরমধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুদান থেকে এসেছে। শীঘ্রই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ বেওয়ারিশ পুর্ণবাসন কেন্দ্রটির সকল কার্যক্রম শুরু হবে।
করোনাকালীন সময়:
বিশ্বব্যাপী করোনাকালীন সময়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। সবাই তখন আতঙ্কিত ও শঙ্কিত। এটা এমনই এক ভাইরাস, কেউ আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে তার পাশে কেউ যাচ্ছিল না। অত্যন্ত কাছের মানুষও পর হয়ে গিয়েছিল। ওই দুর্যোগকালে লকডাউনের জন্য অনেকে বাড়ির বাইরে যেতে পারছিলো না। খেটে খাওয়া দিনমজুর ও অনেক মধ্যবিত্ত মানুষও খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন অতিবাহিত করেছে।
ওইসময় অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন অতিবাহিত করা মানুষদের জন্য মানুষকে বলে খাবারের ব্যবস্থা করা, বাড়িতে বাড়িতে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া, অনলাইন ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে জরুরি রক্তের প্রয়োজনে রক্তের ব্যবস্থা করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সহযোগিতা করা, করোনায় মানুষকে সচেতন করে লিফলেট বিতরণ, বিনা মূল্যে গরিব মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণসহ হাত ধোয়ার জন্য সাবান দেওয়া, লকডাউনে মানুষকে ঘরে থাকতে সচেতন করা। নিজের জীবন বাজি রেখে এমন অনেক কাজে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দেখা যায় মিজানকে।
মিজান শুধু একজন মানবতার ফেরিওয়ালাই নয় :
মিজানের কোন একাডেমিক শিক্ষা না থেকেও নিজের উদ্ভাবন শক্তি দিয়ে একের পর এক নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে দেশসেরা উদ্ভাবক এর খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য সাফল্য সনদ, ক্রেস্ট ও পুরস্কার পেয়েছেন।
মিজানের আরো কিছু সামাজিক ও মানবিক কাজ :
বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় কোরআন বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, গরীব ও অসহায় ছাত্র ও ছাত্রীদের শিক্ষা সামগ্রী ও গাইড প্রদান, টিউবওয়েল স্থাপন, ঘর মেরামত, পাখির বাসা স্থাপন, বন্যার্তদের সাহায্য।
প্রত্যক্ষদর্শী ইকবাল বলেন, মিজান সত্যিই একজন নিবেদিত প্রাণ হয়ে অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমার দেখা চোখে মিজান… অসহায় মানুষের অর্থ সহায়তা প্রদান, চিকিৎসা সেবা প্রদান, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে উদ্ধার চিকিৎসা ও সেবা প্রদান, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা প্রদান, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ, প্রতিবছর ঈদ বাজার বিতরণ, প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার প্রদান, হারানো ব্যক্তিকে খুঁজে দেওয়া, সেলাই মেশিন প্রদান, অটোভ্যান প্রদান, শীতের পোশাক বিতরণ, গৃহপালিত পশু সহায়তা প্রদান, অসহায় মেয়ের বিয়ের জন্য সহায়তা প্রদান ও অসহায় মানুষকে পুনর্বাসনসহ নানাভাবে সহায়তা করেছেন। এমনকি সারা দেশে ১ লাখ কোরআন বিতরণের মিশনে নামেন মিজান, যা এখনো চলমান রয়েছে।
মিজান বলেন, ২০০১ সাল থেকেই তিনি মানবসেবা কাজের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি অনেক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। মানবিক কাজ করতে গিয়ে একমাত্র ছেলে সঙ্গে তার প্রচন্ড রাগারাগি হয়। তিনি যখন সামাজিক ও মানবিক কাজে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দুইটা ভিটেবাড়ি বিক্রি করা টাকা, সারাজীবনের সব সঞ্চয়। একমাত্র ছেলে তার এসব কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। এক পর্যায়ে বাবা ছেলের মধ্যে প্রচন্ড রাগারাগি হয়। মিজানের সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডগুলো এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে। পরবর্তীতে ছেলেও বাবার সঙ্গে মানবিক কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। বর্তমানে তার ছেলে বাবার হাতে গড়া হযরত শাহজালাল (রহ:) লতিফিয়া মডেল মাদ্রাসা ও এতিমখানায় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মিজান আরও বলেন, মানবসেবা করতে গিয়ে সবকিছু দান করে দিয়েছি। এখন আমার বলতে কিছু নেই। একমাত্র সন্তানের জন্যেও কিছু রাখা হয়নি। জীবনের কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি মানবিক কাজ করে আত্মতৃপ্তি পাই। কারো কোনো উপকার করতে পারলে নিজের কাছেও ভালো লাগে। দিনশেষে একজন অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারি, একটা আটক বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে মুক্ত আকাশে উড়াতে পারি এটা তৃপ্তি, এটাই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়। যতদিন বেঁচে আছি আজীবন মানবসেবা করে যাবো।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন (বিএইচআরসি) ঝিকরগাছা শাখার সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, সামাজিক ও মানবিক কাজ মানুষ অনেকভাবেই করে। কিন্তু মোটর মেকানিক মিজানের সামাজিক ও মানবিক কাজগুলো আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। আমি মোটর মেকানিক মিজানকে সাধুবাদ জানাই, করোনাকালীন সময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দিয়েছে, মানুষকে সচেতন করে লিফলেট বিতরণ, বিনা মূল্যে গরিব মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণসহ হাত ধোয়ার জন্য সাবান দেওয়া, লকডাউনে মানুষকে ঘরে থাকতে সচেতন করা। নিজের জীবন বাজি রেখে এমন অনেক কাজে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দেখা যায় মিজানকে। এছাড়া কনকনে এই শীতে ঘরে মন বসে নেই মিজান। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে শীতার্ত গরীব অসহায় ও খোলা আকাশের নিচে থাকা মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণের মাধ্যমে শীত নিবারন করার চেষ্টা করছেন তিনি। আমি যতটুকুই চোখে দেখেছি সত্যিই মিজান সমাজের জন্য অনেক ভালো কাজ করছেন।
শার্শা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বলেন, মিজান আমাদের এলাকার মানুষ। আমি দীর্ঘদিন ধরে দেখছি মিজান বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছেন। অনাহারে দিন পার করা ছিন্নমূল পথ শিশু, পথচারী, ভারসাম্যহীন মানুষদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ফ্রি খাবার বাড়ি’। যেখানে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। শার্শার শ্যামলাগাছীতে একটি মডেল মাদ্রাসা ও এতিমখানা। যেখানে এতিম বাচ্চাদের জন্য পাঠদান ও কোরআন শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন ঝিকরগাছার উত্তর দেউলি গ্রামে বেওয়ারিশ মানুষদের জন্য বেওয়ারিশ পুনর্বাসন কেন্দ্র।যেখানে বেওয়ারিশ মানুষদের ভরণপোষণ দেবেন তিনি। মিজান শুধু যশোরই নয় অন্যান্য জেলাতেও মানবিক কাজের জন্য তার অবদান রেখেছেন। সামাজিক কর্মকান্ড ও মানবসেবা সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ইতোমধ্যে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তার ঝুলিতে জমা হয়েছে অসংখ্য সম্মাননা স্মারক। মিজানের মতো মানবদরদী মানুষ সমাজের জন্যেও ভালো রাষ্ট্রের জন্য ভালো।
শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নয়ন কুমার রাজবংশী জানান, আমি যেহেতু শার্শায় নতুন যোগদান করেছি। এই কয়েকদিনে মোটর মেকানিক মিজান সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি… তিনি অসহায় মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন। তার এধরণের মানবিক ও সেবামূলক কর্মতৎপরতা সত্যিই প্রশংসনীয়।